শিক্ষকদের পড়ানোর স্টাইল

কৃষিকাজ এবং শিক্ষকতা, দুটোই মহান পেশা। এই দুটো পেশার মধ্যে অনেকেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, PhD ডিগ্রিধারী, সফল ব্যবসায়ী এদের কথা তোলেন। কিন্তু একজন ডাক্তার কিংবা একজন ইঞ্জিনিয়ারও কিন্তু তাদের পড়ালেখাগুলো শিখেছে কোনো না কোনো শিক্ষকের হাত ধরে। তাদের প্রতিদিনকার খাওয়া এসেছে কোনো না কোনো কৃষকের কষ্টের হাত ধরে। তাই শিক্ষকতা এবং কৃষিকাজ দুটোই মহান পেশা। এদের মধ্যে শিক্ষকতা নিয়ে কিছু বলবো আজকে, শিক্ষকতা অনেক মর্যাদার একটা পেশা তবে অবশ্যই এরসাথে কিছু শর্ত প্রযোজ্য!

কাউকে কিছু পড়ালেই কিংবা দেখিয়ে দিলেই যেমন শিক্ষক হওয়া যায় না, ঠিক তেমনি বছরের পর বছর উচ্চ কোনো পদের অধীনে শিক্ষকতা করে, দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হয়েও শিক্ষক হওয়া যায় না। শিক্ষকতা করার জন্য কিছু সিস্টেম প্রয়োজন যেগুলো অনেক শিক্ষকই জানেন না, জানলেও সেটা মেনে চলেন না, আবার মেনে চললেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের আশেপাশের পরিবেশে কিংবা আমাদের গার্ডেনস এরা সেই শিক্ষকের চলার পথ থামিয়ে দেয়। বাধ্য হয়ে তখন শিক্ষককে গতানুগতিক পথ ধরতে হয়।

একজন শিক্ষক সবকিছু জানতে বাধ্য না। তবে সে তার ছাত্রছাত্রীদেরকে সবকিছু জানাতে বাধ্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে কোনো শিক্ষকই পুরোপুরিভাবে পড়াটা প্রতিটা ছাত্রের মাঝে বন্টন করে দিতে পারেননা। এটা সেই শিক্ষকের একার দোষ না। সে যত ভালো বুঝাক ক্লাসে, যত টেকনিক শিখাক তার ছাত্রদেরকে, যত বাধ্য করুক তাদেরকে পড়ানোর জন্য, তার সেই অবাধ্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কিছু ভাইরাস থাকে যারা সেই শিক্ষকের টেকনিকগুলো নিতে চায় না। এখানে দোষটা কার? অবশ্যই ছাত্রছাত্রীদের।

আবার প্রতিটা ক্লাসে কিছু ছাত্রছাত্রী আছে যারা ভাইরাস টাইপের না, তারা নতুন কিছু নতুনভাবে শিখতে চায়। তাদের কাছে মুখস্ত বিদ্যা এবং সাজেশনটাই বড় না, যেকারনে তাদেরকে অনেকসময় তাদের বন্ধুরা অমানুষ / সাইকো / প্রতিবন্ধী বলে ডাকে। তাদের একটা দুর্বলতা হচ্ছে তারা তাদের শিক্ষকদের পাগলের মত বিশ্বাস করে। শিক্ষক যাই বলুক না কেনো সেটা তারা চোখ বুঝে মেনে নেয়। শিক্ষক যদি কোনো কিছু ক্লাসে এসে ভুলেও যায় তাহলে তারা শিক্ষকের জন্য মন খারাপ করে। এই ধরনের কিছু ছাত্রছাত্রীদের ভালো শিক্ষকদের ক্লাসে ভাগ্যে জোটে না। তাদের বিশ্বাসকে পুঁজি করে অনেক শিক্ষকই ক্লাসে পড়া ফাঁকি দেন, মনে করেন তার এই স্টুডেন্ট গুলো অনেক মেধাবী, তাদের এত পড়িয়ে লাভ নেই, যা পড়ার নিজ থেকে পড়ুক। এখানে দোষটা হচ্ছে শিক্ষকের।

এরপর হচ্ছে আরেকটা ঘটনা। কিছু শিক্ষক প্রাইভেট কোচিং করান। কিছু ছেলেমেয়ে সেই প্রাইভেট কোচিং-এ গিয়ে পড়েও। কারন ক্লাসে সেই শিক্ষক কিছু পড়ান না, এসে গল্প করে টাইম কাটিয়ে দেন। ক্লাসের বেশিরভাগ স্টুডেন্ট তার কোচিং-এ গিয়ে পড়ে বলে তারাও স্যারকে ক্লাসে কিছু পড়াতে বাধ্য করে না, কোনো জায়গায় পড়া বুঝতে অসুবিধা হলে সেটাও তারা ক্লাসে স্যারকে দেখায় না। তাদের তো স্যারের স্পেশাল কোচিং আছে। সেখানেই তো স্যার সব বুঝিয়ে দিবেন। কিন্তু ক্লাসের সবাই সেই স্যারের কোচিং-এ পড়তে পারে না, সবার বাপের টাকা সমান না। তারা হন্য হয়ে নিজে নিজে পড়ার চেষ্টা করে, সেইসাথে তারা স্যারের কোচিং এর স্পেশাল স্টুডেন্টদের কাছে হাসির পাত্র হয়। এখানে দোষ হচ্ছে শিক্ষক এবং স্টুডেন্ট এদের দুজনেরই।

অহংকারী মনোভাব ছাড়তে হবে যেকোনো শিক্ষককে। শিক্ষকদের অহংকারের মূল কারন হচ্ছে তার স্টুডেন্টদের মধ্যে সেই সবচেয়ে বেশি জানে এটা মনে মনে পোষণ করা। কিন্তু আগেই বলেছি একজন শিক্ষক কখনোই সবকিছু জানে না, সে সাধারণ একজন মানুষ মাত্র। কিন্তু সে তার স্টুডেন্টকে তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সবকিছু জানাতে বাধ্য। অনেক শিক্ষকই আছেন যারা ক্লাসে লেকচার দিলে তার একবিন্দুও ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারে না, কিছু না বুঝেই তারা মাথা ঝাঁকায়। আর তাদের এই মাথা ঝাঁকানোকে পুঁজি করে সেসব শিক্ষকেরা গর্ববোধ করেন, নিজেকে অনেক বড় ভাবেন যে আমার স্টুডেন্ট আমার সব লেকচার বুঝে। আরেক ধরনের শিক্ষক আছেন যারা ক্লাসে পড়াতে পারুক আর নাই পারুক, নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার বড়াই করতে ছাড়েন না। তিনি দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্টক্লাসে ফার্স্ট হয়ে বিদেশে পিএইচডি করে সর্বোচ্চ গ্রেড নিয়ে এসে এখানে ক্লাসে করাচ্ছেন ছেলেমেয়েদের। তিনি দেশের মাস্টার ট্রেইনারদেরও মাস্টার(!) কিন্তু তার কথা যেমন কেউ বুঝে না, তেমনি তার লেকচারও কেউ শুনতে না। তাহলে তার এত এত জ্ঞানার্জন দিয়ে তিনি কি করবেন যদি সেগুলো খানিকটা অংশ তিনি অন্যকে দান না করতে পারেন! বিদ্যা দান করাও একটা আর্ট যা সবাই পারে না। মূর্খ লোকের কাছ থেকে যে জিনিসটা কয়েক সেকেন্ডে শিখে ফেলা যায় সেই জিনিসটা কয়েক বছর ধরেও একজন উচ্চশিক্ষিত লোকের কাছ থেকে শেখা যায় না। বিদ্যা অর্জনে অহংকার না, প্রতিটা শিক্ষকের উচিত তার বিদ্যাটাকে সুন্দরভাবে সবার কাছে ছড়িয়ে দিয়ে তারপর সেটাকে নিয়ে অহংকার করতে।

প্রতিটা শিক্ষকের কোনো একটা বিষয় নিয়ে ক্লাস শুরু করার আগে তাকে একটা রুটিন করে নেয়া উচিত। হোক সে স্কুল-কলেজের শিক্ষক কিংবা কোচিং, ভার্সিটি, মেডিকেল কলেজের প্রফেসর। সেই রুটিনে সে নিজেই নিজেকে টার্গেট দিবে যাতে এই মাসে আমাকে এই এই টপিক শেষ করতে হবে, পরের মাসে আমাকে ওসব টপিক শেষ করতে হবে। জগতে প্রতিটা কাজ নির্ভর করে কাজের ইনডেক্সের উপর। একটা কাজ তখনি সম্পূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় যখন সেই কাজটা একটা রুটিন কিংবা সিরিয়ালের উপর ভিত্তি করে হতে থাকে। তাই একজন শিক্ষক যদি তার ক্লাসের টপিকগুলোকে একটা সূচীপত্রের মত করে রাখতে পারে এবং সেই অনুযায়ী ফলো করতে পারে তাহলে তার পক্ষে সবগুলো টপিকে হাত দেয়া সম্ভব।

"টাকার জন্য বিদ্যা" এই ধরনের ট্যান্ডেন্সি ছাড়তে হবে শিক্ষককে। মাস শেষে মোটা বেতনের টাকা দিচ্ছে, ক্লাসে কি পড়াই না পড়াই সেগুলোতো আর কর্তৃপক্ষ ধরছে না। কিন্তু আমি মনে করি এই ধরনের টাকা কামানো এক প্রকার হারাম ইনকাম। যখন ধার্যকৃত পাওনা অনুযায়ী কাজ করার চেয়ে কম কাজ করে পাওনা পাওয়া হয় তখন সেটা হারাম ইনকামের মধ্যেই পড়ে। এর জন্য দুনিয়াতে কেউ না ধরলেও পরকাল বলে একটা জগত আছে, সেখানে সেই শিক্ষককে ঠিকই জবাবদিহিতা করতে হবে। শুধু কোচিং ব্যবসার টাকাকে হালাল আর স্কুলে চাকরির বেতনকে হারাম বানালে চলবে না।

একজন ভালো শিক্ষকের স্বভাব হতে হবে হাসিখুশিও না আবার বেজারও না। আবার একদম নিউট্রালও না। ক্লাসে প্রতিটা স্টুডেন্টের তিনটা জিনিস তাকে ভালো করে লক্ষ রাখার মত ক্ষমতা থাকতে হবে। তিনটা জিনিস হচ্ছে-

#স্টুডেন্টদের মধ্যে কারা পড়ার জন্য আগ্রহী কারা আগ্রহী না
#কাদের ব্যবহার ভালো আর কাদের ব্যবহার অগোছালো
#কাদের রেজাল্ট ভালো কাদের রেজাল্ট খারাপ হয় এক্সামে

এই তিনটা কন্ডিশনের মধ্যে যাদের দুটো পজিটিভ কন্ডিশন থাকবে তারা নিঃসন্দেহে ভালো স্টুডেন্ট। শিক্ষকের উচিত হবে তাদেরকে নিজের সবটা দিয়ে শিখিয়ে দিতে। তিনটার মধ্যে যাদের একটা ভালো, একটা খারাপ এবং একটা মোটামুটি ভালো-খারাপ মিলিয়ে থাকবে তাদেরকে টেনেটুনে ভালো বলা যায়। শিক্ষকের উচিত হবে তাদেরকেও জ্ঞান বিতরণের চেষ্টা করা। কিন্তু যাদের তিনটাই নেগেটিভ বা খারাপ কন্ডিশন তাদেরকে নিয়ে আর সামনে আগানোর দরকার নাই। এগুলো হচ্ছে ক্লাসের ভাইরাস। কখনোই এসব ভাইরাসকে কন্ট্রোল করার দরকার নেই শিক্ষকের। শিক্ষকের সময় এবং সামর্থ্য দুটোই অপচয় হবে। বেশিরভাগ ভাইরাসের পরিবার অনেক ধনী হয়। তাদের জীবনের চিন্তা করা লাগবে না শিক্ষকের। তারা ভবিষ্যতে শিক্ষকদের চেয়েও অনেক টাকা কামাতে পারে।

যারা বাসায় কিংবা কোচিং এ গিয়ে টিউশনি করে সেসব শিক্ষক স্টুডেন্টকে কোনো টপিক খুব ভালো বোঝানোর পরেও যদি কোনো স্টুডেন্ট শিক্ষকের পড়াকে "পাত্তা" না দেয়, পড়ানোর সময় শিক্ষকের লেকচারকে কেয়ার না করে তাহলে তাকে নিয়ে বেশি দূর আগানোর দরকার নেই। যে আপনার কষ্টকে কেয়ার করতে শিখেনি তাকে এক্সট্রা কেয়ার করার দরকার নাই। সেই স্টুডেন্টের মনে তখন এমন একটা খেয়াল আসে যে তার বইয়ের টপিকগুলোর জন্য তো আপনি সবসময় আছেনই, যখন বাসায় পড়তে বসবে তখন আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারবে ও, আপনি পড়ানোর সময় তার এখন এত সিরিয়াস না হলেও হবে। এদেরকে উচিত শিক্ষা দেয়ার উপায় হচ্ছে একই টপিক আর রিপিট না করা। এক্ষেত্রে দোষ আপনার হবে না, হবে স্টুডেন্টের। সে তখন বুঝবে "সময় গেলে সাধন হবে না"।

প্রতি বছর (স্কুল-কলেজে) কিংবা প্রতি সেমিস্টারে (ভার্সিটিতে) যখন একজন শিক্ষক একই জিনিসগুলো বারবার নতুন নতুন স্টুডেন্টদের কাছে রিপিট করেন তখন স্বভাবতই তার কাছে এগুলো একঘেয়েমি লাগবে। এই একঘেয়েমিগুলো কাটানোর কিছু উপায় আছে। সেগুলো নিয়ে বলছি-

#ক্লাসে স্টুডেন্টদের নিয়ে মাসে অন্তত দুই দিন হলেও বিচিত্র কিছু জিনিসের আয়োজন করা যেতে পারে। যেমন বিভিন্ন ধরনের গেইম, গ্রুপ ভিত্তিক কুইজ-কুইজ, স্টুডেন্টদের পারফরমেন্স শো, প্রতিযোগিতা, পাঞ্জা লড়াই এগুলোর আয়োজন করা যেতে পারে। স্টুডেন্টদের যেমন একঘেয়েমি কমবে, শিক্ষকদেরও একঘেয়েমি কাটবে।

#দলবেঁধে শিক্ষক এবং স্টুডেন্ট মিলে ঘুরতে যাওয়া যায় কাছাকাছি কোনো জায়গায়। ছোটখাটো পিকনিকের আয়োজন করা যায় তাদেরকে নিয়ে। যদি ভার্সিটি লেভেলের শিক্ষক হয় তবে নতুন সিনেমা দেখতে নিয়ে যেতে পারেন সিনেমা হলে তাদের স্টুডেন্টদের।

#প্রতিদিন সিলেবাস অনুযায়ী পড়ানোর পর অন্তত ১০ মিনিট ক্লাস শেষে বাকি রাখা দরকার, যে সময়ে শিক্ষক নিজের জীবনের কোনো ঘটনা, নিজের পছন্দের জিনিস নিয়ে কিছু কথা, নিজের ইচ্ছা কিংবা লক্ষ্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে শেয়ার করা, কোনো ইন্টারেস্টিং নিউজ কিংবা ঘটনা তাদেরকে জানানো, নতুন কোনো স্থান নিয়ে তাদেরকে বলা এসব কাজ করতে পারেন। তখন একদল আপনার কথা কানেও তুলবে না, আরেকদল ছাত্রছাত্রী খুব মনযোগ দিয়ে সেটা শুনবে, তারাই আপনার অনুপ্রেরণা, তারাই আপনার পরিবর্তিত ক্লাসের এনার্জি।

একটা সময় ছিলো যখন শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্ক ছিলো ফ্যামিলির মত। ছাত্রছাত্রীরা বড় হয়ে যেতো, ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার হয়ে বের হতো, কিন্তু তাদের বাসায় তখন ক্লাস এইট-নাইনের স্যাররা এসে তখনো দাওয়াত খেতো। কিন্তু এখনকার দিনে ছাত্রের সংখ্যা বেড়ে গেছে, বেড়েছে যোগাযোগের ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীরা ঝুঁকে পড়েছে ফেসবুকে, নতুন নতুন ভার্চুয়াল বন্ধুর ভিড়ে ক্লাসে শিক্ষক যেনো ছায়া। শিক্ষককেও তো ফেসবুকে রাখা যায়, ফোন দিয়ে কিংবা সরাসরি দেখা করার টাইম কোথায়? এটা সত্যি বড় একটা ভুল। শিক্ষকের খোঁজখবর নেয়া উচিত সবার জন্য। কারন শিক্ষকদের মনে অনেক ছেলেমেয়েরা কখনো কখনো দাগ কাটে। তারাও চান না কালের বিবর্তনে তার মনে দাগ কাটা ছাত্রছাত্রীরা হারিয়ে যাক।