পৃথিবীর পরিধির ঐতিহাসিক পরিমাপ!

আমাদের বসবাসযোগ্য পৃথিবী অনেকটা কমলালেবুর মত গোল। গোল বলেই হয়ত তার পরিধি আছে। শুধু পৃথিবী না, যেকোনো গোলক আকৃতির বস্তুরই পরিধি, ব্যাস, ব্যাসার্ধ, কেন্দ্র, চাপ এসব থাকে। ছোট ছোট গোলকাকৃতি বস্তুদের পরিধি খুব সহজেই স্লাইড ক্যালিপার্সের মাধ্যমে মাপতে পারতাম আমরা যখন স্কুল-কলেজে পিজিক্স প্রাকটিক্যাল করতাম। কিন্তু পৃথিবীর মত এত বিশাল একটা গোলকের পরিধি, ব্যাস, ব্যাসার্ধ এসব মাপা কল্পনাতীত ব্যাপার। একটা পিপড়াকে যদি বলা হয় চট করে একটা ফুটবলের পরিধি মাপতে তাহলে তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে যাবে তার চেয়েও ছোট আকারের স্লাইড ক্যালিপার্স দিয়ে বিশাল ফুটবলের সম্পূর্ণ পরিধি মাপা। কিন্তু পুরো পৃথিবীকে যদি ফুটবল হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে পৃথিবীর তুলনায় আমরা পিপড়ার চেয়েও অনেক অনেক গুন ছোট। তারপরেও এত ক্ষুদ্র হয়েও মানুষ বসে থাকেনি। মাপার চেষ্টা করেছে পৃথিবীর পরিধিকে।
ইরাটোস্থিনিস নামক একজন গ্রীক পন্ডিত শুধুমাত্র ইউক্লিড জ্যামিতির ব্যবহার করেই পুরো পৃথিবীর পরিধি প্রায় নির্ভুলভাবে মেপে ফেলেছিলো তার সময়। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৬ সনে তখনকার গ্রীসের সিরীন শহরে (এখনকার লিবিয়ার আসোয়ান শহর) জন্ম নেন। তখন আলেকজান্দ্রিয়া শহরে একটা বিখ্যাত লাইব্রেরী ছিলো যেটাতে বিভিন্ন দেশ থেকে জ্ঞানী লোকেরা এসে বই রাখতেন এখানে। তখনকার দিনে হাতে লেখা বই ছিলো একমাত্র বই। তাই লাইব্রেরী থেকে বই হারিয়ে গেলে সেটার আর কপি পাওয়া যেত না। এই লাইব্রেরী ছিলো শহরটার জ্ঞানের আধার। জ্ঞানপিপাসুদের জন্য স্বর্গ ছিলো জায়গাটা। ইরাটোস্থিনিস এই লাইব্রেরীতে কাজ করার দায়িত্ব পাওয়ার পর জ্ঞানের বিকাশ ঘটে তার। বিভিন্ন লেখকের ভ্রমণ বিষয়ক বই পড়ে তিনি নিজে পৃথিবীর একটা সাধারন মানচিত্র দাড় করাতে পেরেছিলেন। এছাড়া তিনি প্রাচীন ক্যালেন্ডার এবং দিন গননা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি একটা নির্দিষ্ট রেঞ্জ পর্যন্ত মৌলিক সংখ্যা (prime number) বের করার একটা অভিনব উপায় বের করেন যেটা এখন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করে।
ইরাটোস্থিনিসকে ডাকা হতো গ্রীক বর্ণের দ্বিতীয় অক্ষর বিটা(β) নামে কারন তিনি সবখানে দেরি করে আসতেন। তিনি একজন শখের কবিও ছিলেন। সেই "ইউরেকা ইউরেকা" বলে চিৎকার করে উঠা আর্কিমিডিসের সাথে তার ভালো বন্ধুত্বও ছিলো।
ইরাটোস্থিনিস খ্রিষ্টপূর্ব ২৩৬ সনে একদিন লক্ষ করলেন যে বছরের নির্দিষ্ট একটা দিনে সূর্য সিরীন শহরের ঠিক মাথার উপর থাকে। এখনকার সময় দিনটা হচ্ছে ২১শে জুন। সেদিন একটা কুয়ার তল পর্যন্ত সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে। এমনকি একটা খাড়াভাবে পুঁতে রাখা লাঠিরও কোনো ছায়া দেখা যায় না।

কিন্তু ঠিক ওই দিন আলেকজান্দ্রিয়া শহরে খাড়াভাবে পুঁতে রাখা একটা লাঠির ছায়া পড়ে। কারন সূর্যরশ্মি সবসময় সমান্তরালভাবে আলো দেয় পৃথিবীতে এবং পৃথিবী গোলাকার বলে পৃথিবীর নির্দিষ্ট দুরত্বে যেকোনো দুটো স্থান কখনোই একই লেভেলে থাকে না।
ইরাটোস্থিনিস জানতেন যে সিরীনে পোতা লাঠি এবং আলেকজান্দ্রিয়াতে পোতা লাঠি এ দুটোকে পেছনে বাড়িয়ে দিলে এরা পৃথিবীর কেন্দ্রে মিলিত হবে এবং দুটোর বাড়ানো অংশের মধ্যে একটা কোণের তৈরি হবে।

আবার আলেকজান্দ্রিয়াতে পোতা লাঠিটা তার ছায়ার সাথে একটা সমকোণী ত্রিভুজ তৈরি করে, যেখানে লাঠি এবং ছায়ার মধ্যকার কোণ হচ্ছে পৃথিবীর কেন্দ্রে তৈরি কোণের সমান। কারন তারা একান্তর কোণ।

লাঠি দুটোকে পেছনে বাড়ালে তারা পৃথিবীর কেন্দ্রে যে কোণ উৎপন্ন করার কথা সেটা কিন্তু মাপা একদমই অসম্ভব কারন পৃথিবীর কেন্দ্রে আজ পর্যন্ত কেউই যেতে পারে নি। তাই ইরাটোস্থিনিস আলেকজান্দ্রিয়াতে পোতা সেই লাঠিটির সমকোণী ত্রিভুজ থেকে লাঠি এবং ছায়ার মধ্যবর্তী কোণ বের করেছিলেন যেটার পরিমান ছিলো ৭ ডিগ্রি ১২ মিনিট। এবং ঠিক তখনি এই ৭ ডিগ্রি ১২ মিনিট পরিমান কোণই পৃথিবীর কেন্দ্রে উৎপন্ন হবার কথা ছিলো লাঠি দুটো পেছনে বাড়ালে তাদের মিলিত বিন্দুতে, অর্থাৎ পৃথিবীর কেন্দ্রে।
পৃথিবী একটা গোলক বলে এর কেন্দ্রে সম্পূর্ণ কোণের মান ৩৬০ ডিগ্রি। আর ইরাটোস্থিনিস এই ৩৬০ ডিগ্রি এর ৫০ ভাগের এক ভাগ মানে ৭ ডিগ্রি ১২ মিনিট পরিমান বের করতে পেরেছিলেন পৃথিবীর কেন্দ্রে, সেই ছায়া এবং লাঠিটা দ্বারা।
আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সিরীনের দুরত্ব ছিলো তখনকার সময় অনুসারে ৫০০০ স্টেডিয়া (মিশরীয় স্টেডিয়ার হিসাব অনুসারে ১ স্টেডিওন = ১৫৭ মিটার প্রায়)। তিনি হিসাব করলেন ৭.১২ ডিগ্রি কোণের জন্য ৫০০০ স্টেডিয়া হচ্ছে পৃথিবীর উপর দুটো জায়গার দুরত্ব। তাহলে পুরো ৩৬০ ডিগ্রির জন্য যতটুকু দুরত্ব সে পাবে সেটাই কিন্তু পৃথিবীর পরিধি!
তিনি পৃথিবীর কেন্দ্রে ৭.১২ ডিগ্রি অথবা ৩৬০ ডিগ্রির এক ভাগের জন্য দুরত্ব পান ৫০০০ স্টেডিয়া, আবার ৩৬০ ডিগ্রি অথবা ৫০ ভাগের জন্য দুরত্ব পান ৫০*৫০০০ স্টেডিয়া= ২৫০০০ স্টেডিয়া! অর্থাৎ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে ঘুরে এসে আবার সেই প্রান্তে আসতে হলে ২৫০০০ স্টেডিয়া দুরত্ব পাড়ি দিতে হবে।
এই ২৫০০০ স্টেডিয়া হিসাবটাই হলো এই বিশাল পৃথিবীর পরিধি। সত্যি আশ্চর্কর! যদি মাইলে হিসাব করতে যাই তবে সেটা ২৪৬৬০ মাইল পাবো আমরা, যেটা একেবারে নিখুঁত পরিধির মান ২৪৯০০ এর চেয়ে মাত্র ০.১৬% ভুল!
ইরাটোস্থিনিস এভাবে বের করেন পৃথিবীর কেন্দ্রে প্রতি ডিগ্রি মানের জন্য পৃথিবীর উপর দুরত্ব ৭০০ স্টেডিয়া।
শুধু পরিধি মাপার এই চমৎকার হিসাবটাই নয়, ইরাটোস্থিনিস আরো অনেক মজার হিসাব নিকাশ করেছিলেন। তিনি পৃথিবী থেকে চাঁদ এবং সূর্যের দুরত্বও বের করেছিলেন। এমনকি সূর্যের পরিধি পৃথিবীর প্রায় ২৭ গুন এটাও তিনি বের করেছিলেন কিন্তু দুঃখজনকভাবে আসল হিসেবে সূর্যের পরিধি পৃথিবীর ১০৯ গুন বড়।
এই জ্ঞানী অনন্যসাধারণ গণিতবিদ খ্রিষ্টপূর্ব ১৯৪ সনে ৮২ বছর বয়সে মারা যান কিন্তু রেখে যান তার অসামান্য গানিতিক দক্ষতার প্রমাণ।