মেয়ে ক্লাসমেট!

স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি, তিনটা জায়গায় আমাদের (মানে ছেলেদের) কম-বেশি মেয়ে বন্ধু জোটে। যারা খুব ভদ্র ছেলে তাদের মেয়ে ফ্রেন্ড থাকে না বললেই চলে। তবে কিছু ছেলে আছে যাদের এলার্জি থাকে মেয়েদের প্রতি। তাই ওদের কথা শুরুতেই বাদ। ওরা মেয়েদের বিশেষ গোছের কোনো প্রাণি ভাবে, না হয় মেয়েদেরকে প্রচন্ড ভয় পায়, কিংবা মেয়েদের নিয়ে সারাক্ষণ উল্টাপাল্টা চিন্তা করে, উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলে বেড়ায় বন্ধুদের সাথে। তাই মেয়েদের সাথে তাদের তেমন একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠে না। আমি এখানে ফোকাস করতে চাচ্ছি একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ের বন্ধুত্ব কেমন হতে পারে, তাদের মধ্যে বোঝাপড়া কেমন হতে পারে সেগুলো নিয়ে।

তবে একটা কথা শুনতে খুব খারাপ লাগলেও কথাটা সত্য। একটা মেয়ে একটা ছেলের যত ভালো বন্ধুই হোক না কেনো, একটা ছেলে কখনোই একটা মেয়ের খুব ভালো বন্ধু হতে পারে না, বন্ধুর চেয়ে আরো বেশি কিছু হতে চায়। অন্তত একবার হলেও মেয়েটার পাশে নিজেকে মনে মনে তার অর্ধাঙ্গ হিসেবে কল্পনা করে। মেয়েটাকে নিয়ে একবার হলেও সে স্বপ্ন দেখে জীবনে। মেয়েটাকে নিজের ভালোবাসার মানুষ ভাবে। কোনো কোনো ছেলেদের এই মোহটা বেশ কিছুদিন থাকে, তারপর আস্তে আস্তে কমে যায়। কিন্তু কিছু ছেলেরা সবসময় তাদের সবচেয়ে কাছের বান্ধবীকে নিজের প্রিয় মানুষ হিসেবে ভাবতে ভালোবাসে। তবে খুব কম সংখ্যক মেয়েরা সেটা বুঝতে পারে। সেজন্য ছেলে বন্ধুটা সবসময় একটা এক্সট্রা কেয়ার চায় মেয়েটার কাছে ভালোবাসার মানুষ হিসেবে। কিন্তু মেয়েটা তাকে বন্ধু ভেবেই সেই এক্সট্রা কেয়ারটা করে না। সেজন্য ছেলেটা প্রায়ই মন খারাপ করে থাকে, কিন্তু মেয়েটা আগের মতই হাসিখুশি থাকে।

একটা মেয়ের সাথে একটা ছেলের বন্ধু হিসেবে প্রথম পরিচয় হবার পর চারটা ঘটনা ঘটতে পারে। প্রথমত তারা দুজন বন্ধু হয়ে যেতে পারে। মাঝেমাঝে কথা হয় তাদের মধ্যে, ক্লাসে দেখা হয়, কেউ হয়ত কাউকে চা খাওয়ায়। ব্যস! এভাবে কয়েক মাস, কয়েক বছর চলে যায়।

দ্বিতীয়ত যেটা ঘটে সেটা হলো তারা দুজন বেশ ভালো বন্ধু হয়ে যায় কয়েকদিনের মাথায়। একইসাথে ক্যাম্পাসে ঘোরে, একজনের কাজ আরেকজন করে দেয়, একইসাথে ক্লাসে পাশাপাশি বসে, চুল টানাটানি থেকে শুরু হয়ে কিল-ঘুষি সব কিছুই চলে তাদের মধ্যে। অনেকে তাদেরকে কাপল বলে ভুল করে কিন্তু তারা জাস্ট ফ্রেন্ড।

তৃতীয়ত আরেকদল ছেলে এবং মেয়েরা বন্ধু হবার পর কিছুদিন ধরে তাদের বন্ধুত্ব থাকে। তারপর হঠাৎ একদিন তাদের মাঝে ঝগড়া লাগে। হয়ত খুব সামান্য বিষয় নিয়ে, কিংবা খুব বড় বিষয় নিয়ে। ফলে একে অপরের শত্রু হয়ে যায় এবং যতদিন একসাথে ক্লাস করে ততদিন কথাবার্তা হয় না তাদের মধ্যে। তবে এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার নিজেদের ঝগড়া মিটমাট করে নেয়। আগের মত বন্ধু হয়ে যায় দুজনে।

চতুর্থ কন্ডিশনে যেটা হয় সেটা হলো বন্ধু হবার কিছুদিনের মধ্যেই তারা রিলেশনে জড়িয়ে পড়ে। নতুন রিলেশনে যাওয়াটা তাদের কাছে স্বর্গীয় মনে হয়। অবশ্য এদের অনেকের রিলেশন টিকে থাকলেও বাদবাকিদের টেকে না। এরা ক্লাসে অনেক বিখ্যাত কাপল হয়ে যায় অল্পকিছুদিনের মধ্যেই। তবে ব্রেকাপের পরে তাদের নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনাও চলে ক্লাসে।

সবার প্রথম একটা মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হলে যেটা করা যাবে না সেটা হলো সেই মেয়েকে কখনোই নিজের ভাবা যাবে না। নিজের ভাবা মানে হচ্ছে নিজের ভালোবাসার মানুষ মনে করা। এতে সমস্যা হচ্ছে মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় একই রকম থাকে না। হয়ত যে মেয়েটা আজকে তোমাকে দেখে হাসিমুখে কথা বলছে সে আগামীকাল কিংবা আগামী হপ্তায় তোমার সাথে হাসিমুখে কথা নাও বলতে পারে। প্রতিটা ছেলেই ভুল বোঝে তখন মেয়েটাকে, কেননা ছেলেরা মনে মনে নিজের ভাবতে শুরু করে মেয়েটাকে। মেয়েটা কথা বললে কিংবা কথা বলার মুডে না থাকলে কেউ কেউ বলে মেয়েটার প্রব্লেম আছে, কারো কারো কাছে মেয়েটা প্রতিবন্ধী হয়ে যায় তখন, কিংবা কেউ কেউ মেয়েটাকে অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করেও ডাকে তখন। চিন্তা করো যে ছেলেটা সেই মেয়েটার বন্ধু সে-ই মেয়েটাকে উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করে দেয় মেয়েটা তার সাথে কথা না বললে! আর বাহিরের মানুষ তো মেয়েটাকে নিয়ে আরো কতকিছু বলবেই! কিন্তু ছেলে হিসেবে তোমাকে বুঝতে হবে মেয়েদের সাইকোলজিক্যাল দিকটাই এমন। তাদের আচার-আচরণ কখন কেমন হয়ে যায় সেটা বড় বড় কবিরাও অতীতে বুঝে উঠতে পারেননি। এটা কখনোই তাদের দোষ না। তুমি যেমন রগচটা কিংবা অস্থির স্বভাবের হলে সেটা যেমন নিজের দোষ হিসেবে দেখো না, ঠিক তেমনি একটা মেয়ের মতিগতি বুঝতে গিয়ে সেটা ধরতে না পেরে মেয়েটাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করা ঠিক না। তুমি যদি ভালো ছেলে হও তবে লাইফে একটা কেনো, অসংখ্য ভালো মেয়েবন্ধু পাবে।

মেয়ে বন্ধুর সাথে কথা বলার সময় কখনোই তার শরীরের দিকে তাকিয়ে কথা বলা উচিত না, হোক সে বহুদিনের পুরোনো বন্ধু। কেননা সে একজন মেয়ে। অন্যের স্ত্রী। চোখে চোখ রেখে কথা বলাটা সব মেয়েরাই পছন্দ করে। অনেক মেয়ের চোখ খুব গভীর থাকে, তাকালে মনে হয় যেনো ভেতরটা সে পড়ে ফেলতে পারছে। এসব মেয়েদের চোখের দিকে তাকালে কিছুটা অস্বস্তি এবং ভয় ভয় লাগে। কিন্তু তারপরেও কথা বলার সময় সেসব মেয়েদের চোখের দিকে তাকিয়েই কথা বলতে হবে। তুমি যেমন তোমার চোখ দিয়ে মেয়েটাকে দেখছো, মেয়েটাও ঠিক তার চোখ দিয়ে তোমাকে দেখছে। তার চোখের তীক্ষ্ণ গঠন এবং সেই চোখ দিয়ে তোমাকে দেখার মধ্যে পার্থক্য অনেক। চোখে চোখ রেখে কথা বলার ট্রাই করবা। ট্রাস্ট মি, তোমার মেয়ে বন্ধুটা অনেক খুশি হবে।

মেয়েরা যার কাছে গুরুপ্ত পায় না তার সাথে তত একটা মেশে না। তাই তোমার নতুন পরিচিত মেয়ে বন্ধুটির প্রতিটা কাজ গুরুপ্ত সহকারে দেখবে, প্রতিটা কথা গুরুপ্ত সহকারে শুনবে। তখন মেয়েটা বুঝবে যে তুমি তার সব কথা মন দিয়ে শুনছো, কখনো বিরক্ত হওনি কিংবা অন্যমনস্ক ছিলে না মেয়েটার কথার প্রতি। ফলে তোমার মেয়ে বন্ধুটা তার জমিয়ে রাখা আরো কথা, গল্প, ইচ্ছা, কল্পনা সব তোমার সাথে শেয়ার করবে। তবে কখনোই তুমি তার প্রতি বিরক্ত হবে না। মেয়েটি আস্তে আস্তে খুব ভালো বন্ধু হয়ে যাবে তখন তোমার।
মেয়েরা মোটিভেটেড হতে ভালোবাসে। চেষ্টা করবা তোমার মেয়ে বন্ধুকে সব কাজেই মোটিভেট করার জন্য। ও মুখ দিয়ে হাজারবার বলবে তুমি ওকে পাম দিচ্ছো। কিন্তু মন থেকে সত্যিই সে তোমার প্রতি খুশি হবে যদি তাকে তুমি অনুপ্রাণিত করো। তার রেজাল্ট খারাপ হলে তুমি তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে পারো না, অনেক মেয়েরা এটাকে সিরিয়াসলি নেয়। তাকে inspire করো। হয়ত সে খুব ভালো গান গাইতে জানে না। তাই গুনগুন করে গান গায়। তাকে inspire করো। কোনো কোনো মেয়ে নিজেকে অনেক ছোট ভাবে। "আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না" এমন গোছের মেয়েদের সাথেও তোমাকে বন্ধুত্ব হবে। তাকে অনুপ্রেরণা দাও। অনুপ্রেরণা এক ধরনের আনন্দ। অনিশ্চয়তায় থাকা মেয়ে বব্ধুকে inspired করলে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না, বরং সে তোমার থেকে আরো বেশি অনুপ্রাণিত হবার আশায় ভালো বন্ধু হয়ে পাশে থাকবে সবসময়।

আমরা প্রশংসা করতে চাই না কেউ। কার কি দোষ আছে সেগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করেই সারাজীবন কাটে আমাদের। Don't do this to your Girl Friend! মেয়েরা নিজেদের দোষকে খুব সিরিয়াসলি নেয়। তুমি তোমার মেয়ে বন্ধুর চেহারা নিয়ে হাসাহাসি করলে সে তোমাকে কখনোই ভালো চোখে দেখবে না। মেয়েদের কাছে চেহারা জিনিসটা শরীরের চেয়েও অনেক মূল্যবান। খুত ধরার স্বভাবটা বদলাতে হবে তোমাকে। মেয়ে বন্ধুর প্রশংসা করতে হবে। কিন্তু প্রশংসা জিনিসটা আমাদের মধ্যে অতটা আসে না এখন। যে যেভাবে পারি মেয়ে বন্ধুকে পচাতে বাকি রাখি না। এতে আমরা অনেক মজা পাই এবং মেয়েটাও মজা পাওয়ার ভান করে আমাদের সাথে হাসে। কিন্তু দিন শেষে সে আয়না দেখে, তাকে কেনো ক্লাসে চাকমা টাইপের বলা হয়েছে সেটা নিয়ে সে ভাবে। আচ্ছা! আমাকে কেনো ওরা বাঁটুল বললো ক্লাসে? ফিতা দিয়ে নিজের উচ্চতা মাপে তখন মেয়েটা। ওরা বলে আমার চুল নাকি কোঁকড়ানো! চিরুনি দিয়ে তখন সমান করে চুল আঁচড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালায় মেয়েটা। মেয়েদেরকে নিয়ে কে কি বলছে সেটা মেয়েটা খুব ভালো করে মেমরিতে রাখতে পারে। তাই প্রশংসা করো মেয়ে বন্ধুটিকে। মাঝেমধ্যে তাকে মন থেকে সুন্দর বলো। তার রেজাল্টের প্রশংসা করো। সে কিছু রান্না করে তোমাকে খাওয়ালে রান্না ভালো না হলেও সেটার প্রশংসা করো। খুব খুশি হবে সে। বিলিভ ইট অর নট! তোমার প্রশংসা পেয়ে পেয়ে তাকে কোন ড্রেসে ভালো মানায় সেটাও সে তোমার মুখ দিতেই শুনতে চাইবে।

সোস্যাল মিডিয়া এক্টিভিটি! মেয়ে বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব ভাঙ্গার অন্যতম বড় কারন হচ্ছে সোস্যাল মিডিয়া। টুইটার, ইউটিউব, ইমো, হোয়াটস অ্যাপ এগুলোর জন্য মেয়েদের সাথে তেমন কারোই বন্ধুত্ব নষ্ট হয় না। সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব নষ্টের কারন হচ্ছে ফেসবুক এবং মেসেঞ্জার। ফেসবুক মানুষের অনেক পার্সোনাল একটা জিনিস। পার্সোনাল জিনিস গুলোর প্রতি মেয়েদের সেনসিটিভিটি অনেক বেশি। তাই তোমার মেয়ে বন্ধুটি যদি ফ্রেন্ডলিস্টে থাকে তবে তাকে নিয়ে এমন কিছু করা উচিত হবে না ফেসবুকে যাতে সেটা তার বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়ায়। অযথা তাকে যেকোনো ছবি ট্যাগ করা, বিভিন্ন গ্রুপে গ্রুপে তাকে এড করা, তাকে মেনশন করে ফেসবুকে হাস্যকর কিংবা এমন কোনো স্ট্যাটাস দেয়া যেটা তার প্রেস্টিজে লাগে, তাকে ঘনঘন মেসেঞ্জারে জ্বালাতন করা, তার ছবি দিয়ে ট্রল বানিয়ে পেইজে কিংবা গ্রুপে পোস্ট করা, তাকে বিরক্তিকর ইমোটিকন পাঠানো, গোপনে তার অপ্রস্তুত অবস্থায় ছবি তুলে সেটা তার টাইমলাইনে পোস্ট করা, অনুমতি না নিয়েই তাকে মেসেজ গ্রুপে এড করা, তার প্রতিটা স্ট্যাটাসের নিচে তাকে পচিয়ে কমেন্ট করা, চার-পাঁচটা আইডি দিয়ে তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো, ঘুমানোর টাইমে মেসেঞ্জারে তাকে কল দেয়া এসব কাজ মোটেও করার ট্রাই করবে না তোমার নতুন মেয়ে ফ্রেন্ডের সাথে। তবে তোমার বন্ধুটি যদি অনেক পুরোনো কিংবা খুব ভালো বন্ধু হয় তবে ফেসবুকে এগুলোর কিছু কিছু করা যায়, এতে বন্ধুত্ব নষ্ট হয় না।

কোনো ছেলের মেয়ে বন্ধু থাকার মানে এই না যে সেই ছেলেটা খারাপ কিংবা প্লেবয় টাইপের। একটা মেয়ে আরেকটা মেয়েকে যে পরিমান উপকার করে তার চেয়েও বেশি উপকার করে ছেলেদের। কাপল কিংবা দম্পতি ছাড়া ছেলে এবং মেয়ে বন্ধুদের মাঝে ঝগড়া খুব কমই হয়। সবসময় চেষ্টা করবে তোমার মেয়ে বন্ধুকে সাহায্য করতে,। তার সাথে ভালো ব্যবহার করতে। তাকে কখনো নিজের নায়িকা হিসেবে দেখার ট্রাই করো না, বোনের মত করে দেখো। তা না হলে ফিউচারে তোমাদের মাঝে ঝগড়া লাগবে, দুজনকেই কষ্ট পেতে হবে।