স্কুল জীবন মাত্র দুই বছর হবার সত্ত্বেও (মাত্র ক্লাস নাইন আর টেন, বাকি ক্লাসগুলোতে বাসায় থেকে ঘুড়ি উড়াতাম) কোনো ক্লাসেই মেয়েদের সান্নিধ্য পাইনি। ছেলেদের ক্লাসে ছেলেরা, মেয়েদের ক্লাসে মেয়েরা। কখনো কখনো আমার বন্ধুরা ভুল না করে মেয়েদের ক্লাসের সামনে চলে গেলেও মেয়েরা কখনো ভুল করেও আমাদের ক্লাসের সামনে আসতো না। কিন্তু এসএসসির কোচিং ক্লাসে সেই বাধ্যবাধকতা নেই। এখানে মেয়েরা আমাদের সাথে ক্লাস করার সুযোগ পেলো। জীবনে প্রথমবারের মত মেয়েদের স্বভাব-চরিত্র-অনুভূতি বুঝতে শিখলাম। ক্লাসের ফাঁকেফাঁকে তাদের কচি কচি মুখের দুষ্টুমিবিদ্যা, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল, প্রাইমারি-সেকেন্ডারি থেকে শুরু করে টারশিয়ারি লেভেল পর্যন্ত রাগারাগি, চুলোচুলির টেকনিক সবকিছুই নিজের চোখে দেখতে পেয়েছিলাম তখন।
আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে সুন্দরী ছিলো মাত্র একটা মেয়ে। ওকে আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী বললে ভুল হবে। ও ছিলো পুরো স্কুলের সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের সুন্দরী। নাম নওশীন। নুসরাত নওশীন। চোখগুলো অন্যরকম সুন্দর ছিলো তার। বড় বড় ডাগর চোখ। বেশিরভাগ সুন্দরী মেয়েরা স্বভাবতই কিছুটা কম বুদ্ধিমান হয়, পড়ালেখা কম বুঝে। কিন্তু নওশীন ব্যাতিক্রম ছিলো। প্রতিটা পরীক্ষায় সে পুরো ক্লাসে ফার্স্ট হতো। ১০০ তে ৯৭ কিংবা ৯৮ পেতো প্রতিটা সাবজেক্টে। ক্লাসের ফার্স্টবয়কে পেছনে ফেলে সে সবসময় ফার্স্ট হতো। তার এত ভালো রেজাল্টের রহস্য হচ্ছে তার ব্রেইনে ক্যাপচার করার ক্ষমতা। একটা লাইন একবার পড়লে সাথে সাথেই সেটা মনে থাকে তার, কখনো ভুলে না সেটা। একটা অংক স্যার করিয়ে দিলে সেটা শেষ করার বহু আগেই নওশীনের অংক কমপ্লিট হয়ে যায়।
কোচিং ক্লাসের প্রথম দিন আগে আগেই স্কুলে গিয়ে পৌঁছি। বেশ কয়েকজন মেয়ে এসে আমাদের ক্লাসরুমে ঢুকে প্রথমেই বাম সাইডের বেঞ্চগুলো দখল করে নেয়। বুঝতে পারলাম, ওরা বামপন্থী! ক্লাস শুরু হবার কিছুক্ষণ আগে নওশীন এসে ঢোকে ক্লাসরুমে। তাকে দেখে প্রথমে ধাক্কা খাই, পরে অবাক হই, সবশেষে ক্রাশ খাই! কাছের বন্ধুদের কাছ থেকে তার নামটা জেনে নেই। আমার বন্ধুরা বেশ ভালোই জানে কোন মেয়ের নাম কি! নওশীন ক্লাসের সব ছেলেদেরকে মোটামুটি কম-বেশি চিনলেও আমাকে বিন্দুমাত্র চিনতো না সে। তাই হয়ত তাকে এখনো আমার মনে রাখার একটা কারন। নওশীন স্কুলের স্যারদের ব্যাচে পড়তো। সেখানে ক্লাসের অন্যান্য সব ছেলেমেয়েরাও পড়তো। কিন্তু আমি ব্যাচে পড়তাম না। ফলে নওশীন আমাকে চিনতো না। ক্লাসে দু-একবার আমাদের চোখে চোখ পড়তো। কিন্তু সে থাকতো তার চিন্তায় মগ্ন, আমাকে নিয়ে ভাবার অত টাইম ছিলো না তার।
কোচিং এ আমাদের দুটো ফাইনাল মডেল টেস্ট হয়। প্রথমটাতে নওশীনের জিপিএ গোল্ডেণ ৫, গড়ে ৯৭ এর মত নাম্বার এসেছিলো প্রতিটা সাবজেক্টে। ওকে মাথায় নিয়ে নাচতে থাকেন শিক্ষকেরা। বোর্ডে তার গোল্ডেণ এ+ নিশ্চিত বলা যায়। কিন্তু বাধ সাধলো সেকেন্ড মডেল টেস্ট নিয়ে। অসুখে পড়ে নওশীন। প্রচন্ড অসুখ। একটাও পরিক্ষা দিতে পারেনি বেচারী। কিন্তু প্রবেশপত্র দেবার দিন ঠিকই সে এসেছিলো স্কুলে। অসুখে পড়ে বেশ শুকিয়ে গিয়েছিলো তখন সে। বড় বড় চোখগুলোতে কেমন যেনো মায়াবী চাহনি। দেখে মায়াই লেগেছিলো আমার। সেইদিন আমাদের সেকেন্ড মডেল টেস্টের রেজাল্টও দিয়েছিলো। কিন্তু নওশীন তো আর পরিক্ষা দেয়নি। ফলে তার রেজাল্টও হয়নি। সেদিনই শেষ দেখেছিলাম তাকে। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসের কোনো একদিন। এরপর আর দেখা হয়নি।
স্কুলের গন্ডি শেষ করে কলেজে উঠলাম। স্কুলের কলেজে ভর্তি না হয়ে অন্য একটা কলেজে ভর্তি হলাম। কিন্তু নওশীন থেকে গিয়েছিলো স্কুলের কলেজটাতেই। ফলে তাকে কলেজ লাইফে একটিবারের জন্যও কোনোদিন দেখতে পেলাম না। তবে শেষ মুহূর্তে তার দেখা পেয়েছিলাম, সেটা অন্যভাবে এবং আচমকা। আমার এইচএসসির সিট যে কলেজে পড়েছিলো, ঠিক একই কলেজে সিট পড়েছিলো আমাদের স্কুলের কলেজটার। আর এমনভাবে পড়েছিলো যে, আমি যে রুমে পরিক্ষা দিতাম, আমার স্কুল ফ্রেন্ডরা ঠিক পাশের রুমেই পরিক্ষা দিতো। তারা তখন কলেজ চেইঞ্জ করেনি, ফলে তাদের সাথে পরিক্ষার হলে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আবার দেখা হয়ে গেলো! আর আমার পাশের রুমেই তখন নওশীনের সিট পড়েছিলো। দীর্ঘ দুবছর পর আবার তার সাথে দেখা। প্রতিটা পরিক্ষাতেই তাকে দেখতাম। কিন্তু নওশীন কি আমাকে দেখতো? মোটেও নাহ। দুবছর অনেক সময়। সে আমাকে ভুলে গেছে। আমার চেহারা ভুলে গেছে। আর নাম তো জানতোই না! কারন কখনো তার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়নি আমার।
এইচএসসি শেষ করার পর প্রেশার বেড়ে যায় আমার পাবলিকে চান্স পাওয়ার জন্য। তখন কয়েক মাস নওশীনের কথা মনেও আসেনি আমার। তখন নতুন নতুন ফেসবুক addicted হয়েছি আমি। পরিচিত-অপরিচিত সবার প্রোফাইলে গিয়ে দেখতাম কে কি করে। একদিন বিকেলে ছাদে বসে গান শুনছিলাম আর ফেসবুক ব্রাউজিং করছিলাম। হঠাৎ মনে পড়লো নওশীনের কথা। সার্চ দিলাম তার নাম দিয়ে। পেয়েও গেলাম তার আইডি। খুব ভালো একটা সরকারী মেডিকেলে পড়াশোনা করছে এখন সে। সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তার জন্য। ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিতে গিয়েও দিলাম না আমি। কারন আমার রিকুয়েস্ট হয়ত ঝুলিয়ে রাখবে সে।
এখন ২০১৮ সালের জানুয়ারি। ইন্টারের একজন স্টুডেন্টকে পড়ানো শেষ করে বাসার দিকে রওনা দিচ্ছিলাম আজ। সন্ধ্য হয়ে গেছে। কিন্তু পথঘাট, পথের মানুষ তাদেরকে স্পষ্ট দেখার মত আলো ছিলো তখনো। হাটতে হাটতে হঠাৎ চোখ চলে যায় একটা রিক্সার দিকে। একজন মহিলা একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে কোথায় যেনো যাচ্ছেন। পাশে তার স্বামী বসা। এরকম দৃশ্য বহুবার দেখেছি আমি, তাই আন্দাজ করতে কষ্ট হলো না ওনারা স্বামী-স্ত্রী। মহিলাটাকে দেখে কি যেনো ধরি ধরি করেও ধরতে পারছিলাম না আমি। হঠাৎ চমকে উঠি! সেই চেহারা, সেই চোখ, সেই মুখাবয়ব! নওশীন এখন বাচ্চার আম্মু! স্বামীর চেহারাটাও বেশ গাম্ভীর্যপূর্ণ! হয়ত বড় কোনো সরকারী অফিসার গোছের কিছু একটা হবে! আনমনে হেসে হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দিলাম। পাঁচ বছরে কত পরিবর্তন হয়ে গেছে মেয়েটা! আর আমি? এখনো ব্যাচেলর!