অপূর্ণ ইচ্ছা - ১

বিয়ে করতে চাই!

এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাই যে আমার চিরশত্রু। মেয়েটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হবে কলেজে কিংবা ভার্সিটিতে। একটা সময় আমরা বন্ধু হয়ে যাবো। খুব ভালো বন্ধু। রাত জেগে তার সাথে ফেসবুকে কথা বলবো, একসাথে ছবি তুলবো, জন্মদিনের পার্টিতে তার গালে কেক মাখাবো। একইসাথে গ্রুপ স্টাডি করবো, পড়া না বুঝলে বুঝিয়ে দিবো, পরিক্ষার আগের দিন সিট প্ল্যানটা খুঁজে বের করে দিবো, পরিক্ষার হলে পেছন থেকে তার খোঁচানোর অপেক্ষায় থাকবো। টঙ্গের দোকানে বসে তার সাথে চা খাবো, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে তার সাথে ফুচকা খাবো, বাসে দুজন পাশাপাশি বসে বাসায় যাবো। ক্লাসে না আসলে তাকে ফোন দিবো, অসুস্থ থাকলে তার হোমওয়ার্ক করে দিবো, বৃষ্টি পড়ার সময় তার মাথায় ছাতা তুলে নিজেও তার সাথে ছাতার তলে দাঁড়াবো, টিচার পড়া ধরলে পাশ থেকে তাকে ফিসফিসিয়ে বলে দিবো, মাঝে মাঝে তার লম্বা চুল ধরে হ্যাচকা টান দিবো, কখনো কখনো মাথায় হাতও বুলিয়ে দিবো। তাকে যতভাবে সম্ভব হাসানোর চেষ্টা করবো, মাঝেমাঝে অন্য নাম্বার থেকে ফোন করে তাকে ভয় দেখাবো, পেছন থেকে হঠাৎ করে তার চুলের ব্যান্ড খুলে নিয়ে পালাবো, ফেসবুকে হাস্যকর কিছু পেলে তাকে সেটা ট্যাগ করবো, রাতে ঘুমানোর আগে তাকে মেসেজ দিয়ে জ্বালিয়ে মারবো।

আমাকে সে মাঝেমাঝে চিমটি দিবে, পিঠে গুড়ুম করে কিল লাগিয়ে দিবে, ঠেকায় পড়লে দশটাকার সিংগারা কিনে খাওয়াবে, ফুচকা খাওয়ানোর বায়না ধরবে, জন্মদিনের ট্রিট চাইবে, মাঝেমাঝে ভাব ধরবে। আমাকে পরিক্ষার হলে পেছন থেকে গুতা দিবে, ক্লাসে পড়া না পারলে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে, বাসে সিট রাখার জন্য নিজের ব্যাগটা আমার হাতে তুলে দিবে, পরিক্ষায় ভালো মার্কস পেলে আমাকে নিয়ে হিংসা করবে, ফেসবুকে মেসেজ দিলে সেটা seen করে রাখবে, প্রতিদিন আমার কাছে চা খাওয়ার জন্য বায়না ধরবে, বাসের ভাড়াটা আমার উপর দিয়ে চালাতে চাইবে, আমার শীট নিয়ে উধাও হয়ে যাবে পরিক্ষার আগের দিন পর্যন্ত, ফেসবুক হঠাৎ হঠাৎ ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিবে, 'বেকুব-হাফ লেডিস-হনুমান' বলে আমাকে খেপাবে, আমার চশমা নিয়ে নিজের চোখে লাগাবে, মোবাইল দিয়ে নিজের ছবি তুলে দিতে বলবে। বাসে আমাকে সিট থেকে উঠিয়ে সেটা নিজে দখল করে নিবে, ক্লাসে কিছু বুঝতে না পারলে আমাকে প্রতিদিন গুতাবে, পাশাপাশি বসতে গেলে আমার ব্যাগ নিয়ে ফেলে দিবে, টিচারের কাছে শয়তানি ভরা নালিশ দিবে আমার নামে, পাঞ্জা ধরবে আমার সাথে, ফোন না দিয়ে মিসডকল দিবে দরকারের সময়, সেলফি তুলে আমার মুখের জায়গায় বানরের মুখ বসিয়ে ফেসবুকে সেটা আপলোড দিবে।

তারপর হঠাৎ একদিন ঝগড়া লাগবে আমাদের মধ্যে। প্রচন্ড ঝগড়া। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তুমুল ঝগড়া। চোখের বিষ হয়ে যাবো আমরা একে অপরের। কেউ কারো ছায়াও মাড়াবো না। প্রতিদিন ক্লাসে ঠিকই চোখাচোখি হবে কিন্তু কথা হবে না। তার পেছনের সিটে বসবো আমি কিন্তু ফিরেও তাকাবো না তার দিকে। তার কথা মনে আসলে বিষাদে ভরে যাবে আমার মন, আমার কথা সে মনে করলে বিরক্তি চলে আসবে তার মনে। তার কথা শুনলে গা জ্বলে উঠবে আমার, আমার কথা শুনলে পিত্তি জ্বলে উঠবে তার। মোবাইল থেকে দুজন দুজনের নাম্বার কেটে দিবো আমরা। ফেসবুকে ব্লক দিয়ে দিবে সে আমাকে। মন থেকে তার নাম মুছে ফেলবো আমি। কখনো মনে করবো না সে আমার বান্ধবী ছিলো। কখনো সে মনে করবে না আমি তার বন্ধু ছিলাম। বন্ধুত্বের সমস্থ চিহ্ন মুখে ফেলবো আমরা। তীক্ষ্ণ সম্পর্কের মাঝ দিয়ে শেষ হবে আমাদের কলেজ কিংবা ভার্সিটি লাইফ। বেশ কিছুদিন চলে যাবে। ভুলে যাবো আমরা দুজন দুজনকে।

ছোটবেলা থেকেই আমার ফ্যামিলি আমার বিয়ে ঠিক করে রাখবে। কিন্তু আমাকে কেউ জানাবে না। চাকরি পাওয়ার পর বিয়ে করানোর জন্য উঠেপড়ে লাগবে আমার ফ্যামিলি। মেয়েটিও জানবে না তার বিয়ে আমার সাথে ছোটবেলা থেকে ঠিক করা। মেয়েটা আমার মতই ইঞ্জিনিয়ার হবে। তবে খুব ছোটবেলায় আমরা দুজন দুজনকে দেখেছিলাম, এরপর আর দেখা হয়নি তার সাথে। মেয়েটা ইঞ্জিনিয়ার বলে সাচ্ছন্দ্যে রাজি হয়ে যাবো আমি। দুই ফ্যামিলি বিয়েটা একদম পাকাপাকি করে ফেলবে। বিয়ের দিন বউয়ের সাথে আমার দেখা হবে। বউটা আর কেউ হবে না, ওই মেয়েটাই হবে। যে আমার চক্ষুশূল, আমি যার চোখের বিষ! তার সাথে কয়েকবছর আগে ঝগড়া লাগার পর তার কথা প্রায় ভুলেই যাবো আমি। কিন্তু এতদিন পর আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার শত্রুকে অপ্রস্তুত দেখাতে থাকবে। ছোটবেলার চেহারার সাথে কোনো মিলই থাকবে না তার, এমনকি আমারও! কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে ও অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। আমিও চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে থাকবো। অনেক দিন পর দেখা হবে আমাদের, হয়ত কয়েক বছর সময় হবে সেটা। বিয়েতে বাসা ভর্তি অনেক মেহমান আসবে। এতগুলো লোকের সামনে ঝগড়া করতে পারবো না আমরা। আমার বন্ধুরা আসবে বিয়েতে, তার বান্ধবীরা আসবে বিয়েতে। সবার সামনে হাসিমুখে থাকতে হবে আমাদের। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আগুন জ্বলতে থাকবে।

বিয়ের প্রথম রাতে কোনো কথা বলবো না দুজন দুজনের সাথে। বসে বসে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করবো। একইরুমে থাকাটা অসহনীয় হয়ে যাবে আমাদের কাছে। মেয়েটা খুব সুন্দর করে বউ সাজবে সেদিন। আমি তার উপর রেগে থাকলেও মাঝেমধ্যে একটু আধটু উঁকি দিয়ে তাকে দেখবো। এই কয়েকবছরে তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না তার, বরং আরো সুন্দরী হবে সে। রাগ করে সে কিছুই মুখে দিবে না সেদিন কিন্তু খাওয়া না পেলে আমার রাতে ঘুম হয় না, তাই আমি পেট ভরে খেয়ে নিবো। মাটিতে বিছানা করার মত কিছুই থাকবে না আমার রুমে, রাতে মশাগুলোও অনেক জ্বালাতন করে। তাই মশারি টানিয়ে এক বিছানাতেই আমার শত্রুর সাথে রাত কাটাবো। আমি ঘুমিয়ে পড়লেও সে রাতে জেগে থাকবে। জেগে জেগে কান্না করবে। সকালে উঠে তার চোখ আমি লাল দেখতে পাবো। আমার দিকে সে একটুও ফিরে তাকাবে না। আমার মন ততক্ষণে অনেক নরম হয়ে যাবে। মেয়েটিকে আস্তে আস্তে ভালো লাগতে শুরু করবে। কিন্তু তার সাথে কোনো কথা বলবো না বলে আমি ঠিক করে রাখবো সেদিন। অপেক্ষা করবো সে আমাকে কি বলে।

কিন্তু আমি কথা না বলার প্ল্যান নিয়ে থাকলে কি হবে, বিয়ের পরেরদিনই সে আমার সাথে কথা বলবে। সকালের নাস্তা খাবারের জন্য ডাক দিবে। নিচু স্বরে, ভদ্র হয়ে, চোখের দিকে না তাকিয়ে আমাকে ডাকবে সে। আমাকে অবাক করে দিবে তার এই ব্যবহার। হয়ত সবার সামনে ভদ্র সেজেছে, মনে মনে হয়ত আমাকে একশ একটা লাথি দিচ্ছে এখন ও! আমি তখনো তার সাথে কথা বলবো না। তাকে কয়েকবছর আগের চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী লাগবে এখন আমার কাছে। সে আমার মতই একটা চাকুরি করবে। তার অফিস ছুটি থাকবে তখন, বিয়ে উপলক্ষে। আমারও অফিস ছুটি থাকবে, বিয়ের জন্য পাচঁ দিন ছুটো নিবো। সেদিন আর তেমন কোনো কথা বলবো না আমরা। বিকেলের দিকে শুধু তাকে জিজ্ঞেস করবো ওর অফিস কবে থেকে। সে একটু কড়া গলায় উত্তর দিবে তার অফিস সোমবার থেকে। আমি মোবাইলে বসে গেইম খেলতে থাকবো। ও মোবাইলে নতুন একটা নাটক দেখতে থাকবে। আমি ল্যাপটপে বসে ব্লগে লেখালেখি করবো, ফেসবুকে নিউজফিড ঘাঁটবো। আর ও তখন রাতের রান্নার জন্য রান্নাঘরে মায়ের সাথে কাজ করবে, মুরগির গোশত ভুনা করবে। ফাঁকেফাঁকে নিজের মা'কে ফোন দিবে, ভাই-বোনদের ফোন দিয়ে কথা বলবে।

আমাদের মধ্যে বিয়ের পরে কয়েকদিন কোনো ঝগড়া হবে না। কথা কম বলবো বলে ঝগড়া হবার চান্স নেই। সারাদিনে দুই-একবার কথা হবে আমাদের মাঝে। রাতে ঘুমাতে গেলেও কথা বলবো না আমরা দুজন। আমি ব্যস্ত থাকবো লেখালেখিতে, ও ব্যস্ত থাকবে কানে হেডফোন গুঁজে মোবাইলে মুভি দেখাতে। আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সে ঘুমাবে। আর গভীররাতে বসে বসে কান্না করবে। সকালে উঠে আমি তার চোখ দেখে বুঝতে পারবো সে গতরাতে কান্না করেছিলো। আমি কিছু বলতে গিয়েও বলবো না। খুব খারাপ লাগবে হয়ত তখন আমার। মেয়েটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েটা করেছে তাই মানিয়ে নিতে পারবেনা নিজেকে। কিন্তু আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েটা করলেও তাকে আমার ভালো লাগতে থাকবে। ঠিক সেরকম ভালোলাগা যেরকমটা লেগেছিলো যখন আমরা একসাথে ক্লাস করতাম। আমি ওর সাথে ভদ্রভাবে কথা বলতাম, সেও আমার সাথে ভদ্রভাবে কথা বলবে। আমি তার উপর কোনো কাজের চাপ তুলে দিতাম না, যা কাজ করার সেটা সে নিজের ইচ্ছাতেই করবে। মাঝেমাঝে আড়চোখে ও আমার দিকে তাকাবে, নিজের স্বামীকে দেখবে সে। আমিও মাঝেমাঝে তার দিকে তাকিয়ে থাকবো, কিন্তু বুঝতে দিবো না ওকে যে আমি তাকে দেখছি।

একসাথে অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হবো আমরা। রিক্সায় বসেও চুপচাপ থাকবো। কেউ কারো সাথে কথা বলবো না। কিন্ত আমার ইচ্ছা থাকবে কোনো একটা বিষয় নিয়ে তার সাথে কথা বলার। তারও ইচ্ছা থাকবে আমার সাথে আগের মত আড্ডা দেয়ার। কিন্তু দুজনের ইগোর কাছে হেরে যাবে কথা বলার ইচ্ছাটা। সে চুপচাপ রিক্সা থেকে নেমে চলে যাবে, আর আমি তার যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে থাকবো। আস্তে আস্তে তার প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মাবে। অফিসে থাকার সময় তাকে মাঝেমধ্যে টেক্সট করবো, কিন্তু তার রিপ্লে পাবো না। তখন আমি ফোন দিবো তাকে। সে ফোন ধরবে কিন্তু কথা বলবে না। তাকে শুধু একটা প্রশ্ন করেই ফোন কেটে দিবো- তুমি কখন বাসায় ফিরবে? উত্তরে সে হয়ত বলবে সন্ধ্যা ৬ টা। আমি তার জন্য ছোটখাটো গিফট কিনতাম। একটা কাগজে বড় করে লিখতাম- এটা তোমার জন্য। আমার খাটের উপর কাগজটা রেখে তার উপর গিফটা রেখে দিতাম। ও হয়ত আমার দেয়া জিনিসটা নিতো। মনে মনে খুশি হলেও প্রকাশ করতো না সে। গিফট পাওয়ার পর আমাকে থ্যাংকস জানাতো না সে। সবগুলো থ্যাংকস জমিয়ে রাখবে, ভবিষ্যতে কোনো একদিন সবগুলো একসাথে দিবে বলে হয়ত।

কয়েকবছর ব্লক লিস্টে রাখার পর হঠাৎ একদিন আমাকে আনব্লকড করে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাবে সে। কিন্তু আমি সেটা একসেপ্ট করতাম না। অপেক্ষা করতাম সে কবে আমাকে ফেসবুকের কথা বলবে। আত্নীয়-স্বজন কেউ বেড়াতে এলে জিজ্ঞেস করবে কবে আমাদের বাবু আসবে ঘরে। ও লজ্জায় লাল হয়ে যাবে তখন, আমি খুব হেসে উঠবো তাদের কথা শুনে। আমার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকাবে সে, আমি আবার হেসে ফেলবো। সে আরো ক্ষেপে যাবে। আঙ্গুল তুলে নীরবে শাসাবে আমাকে। হঠাৎ একদিন জিজ্ঞেস করবে আমাকে- তুমি আগের ফেসবুক আইডি ইউজ করো নাহ? আমি খুশিতে আত্নহারা হয়ে যাবো তখন। ফেসবুক খুলে তার রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করবো। কয়েকবছর আগে তার দেওয়া মেসেজগুলো সেদিন ঘেঁটেঘেঁটে দেখবো। কি দুষ্টই না ছিলো আমার স্ত্রী! অনেক শয়তানী করে মেসেজ দিতো সে আমাকে কয়েকবছর আগেও। তার প্রোফাইলে সারাদিন আমি বসে থাকতাম। এই কয়েকবছরে তার আপলোড দেয়া প্রতিটা ছবি আমি view full size করে দেখতাম আর ভাবতাম আমার শত্রু কতটাই না সুন্দরী! তাকে সারাদিনে কয়েকবার মেসেজ দিতাম। সবগুলোর রিপ্লে দিতো সে। এই রিপ্লে গুলোই আমাকে সারাটাদিন আনন্দে ভাসিয়ে রাখতো।

প্রতিদিন একটু একটু করে সে আমাকে ভালোবাসতে শুরু করবে, প্রতিদিন একটু একটু করে তার প্রতি আমার মায়া বাড়তে থাকবে। খাবারের সময় সে আমাকে ফোন দিবে, অফিস থেকে বের হবার সময় আমার সাথে বাসায় আসার জন্য অপেক্ষা করবে, মার্কেটে গেলে নিজের পছন্দের শার্ট আমাকে কিনে দিবে, ঝড়বৃষ্টির দিন তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাসায় আসতে বলবে, প্রচন্ড শীতে আমাকে গরম কপি বানিয়ে দিবে। আমি এমন একটা স্ত্রী সবসময় চাইতাম আমার জীবনে। যে একটা সময় আমাকে একটুও দেখতে পারবে না কিন্তু হঠাৎ একদিন ঠিকই আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসবে!