বল+পেন=বলপেন

টাইটেলটা একটা সন্ধিবিচ্ছেদ। এবং সঠিক একটা সন্ধিবিচ্ছেদ। এটা সেই নৈ+এক=নায়কের মত অত জটিল না, খুবই সোজা।

আমরা যে কলম ব্যবহার করে নকল লিখি, বন্ধুর শার্টে আঁকিবুঁকি করি, বান্ধবীর খাতায় চুপিসারে রোমান্টিক কথা লিখে দিই সেই কলমটার নামই বলপেন। মানে ছোটদের খেলার বল আর সাথে থাকে কলম (pen)।


এই বলপেনের ইতিহাসটা বিশাল আকৃতির তবে ছোটখাটো। ১৮৮৮ সালের দিকে এক রাগান্বিত চামড়া ব্যবসায়ী জন লাউডের রাগ হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছিলো। কেননা তিনি তার তৈরি চামড়ার উপর নিজের, নিজের কোম্পানির নামধাম লিখে দেবার জন্য ফাউন্টেনপেন ব্যবহার করতেন। কিন্তু সেগুলো অনেক ঝামেলা ছিলো চামড়ার উপর লেখার জন্য। তাই তিনি রেগেমেগে নিজেই একটা কলম বানালেন যেটার ভেতরে একটা ছোট খোপ ছিলো আর সেই খোপের ভেতর থাকতো কালি। কলমটির মাথায় একটা স্টীলের বল লাগিয়েছিলেন তিনি যাতে বলটা চামড়ার উপর ঘুরে ঘুরে বলের মাধ্যমে কালি লাগাতে পারে। কিন্তু কেনো জানি এটা আর উৎপাদন করলেন না তিনি। মনে হয় জিনিসটা ভালো লাগেনি আর ওনার কাছে। ফলে ওনার কলম বানানোর ইতিহাস এখানেই পাতিহাঁস ঢুকে খেয়ে ফেললো।


জন লাউডের পর অনেকে চেষ্টা করেছিলেন তার পদ্ধতি অবলম্বন করে কলম বানাতে, কিন্তু সেখানেই বাধা হয়ে দাড়ায় শয়তান কালি। কালি জিনিসটা এমন এক চিজ যে বেশী পাতলা হলে সে বলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যেতো। লেখার আগেই কালি বের হতো আরকি। আর কালি জমে গেলে কালি বেরই হতো না। আবার ঘরে তাপমাত্রা কমলে বাড়লেও এই সমস্যা দেখা দিতো। কি মুশকিল কালিটার আচরণ!

তবে তেজী জন লাউডের প্রায় পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন বছর পরে হ্যাংগারির ল্যাডিসলাস বিরো প্রথম কাজ করার মত একটা বলপেন বানান। তিনি ছিলেন আতেল টাইপের মানুষ, মানে ভাস্করের কাজ করতেন আর ছবি আঁকতেন। তিনি আবার নিজে একটা পত্রিকাও চালাতেন। তার বলপেন বানানোর সূচনা হয়েছে সেই পত্রিকা থেকেই। কারন পত্রিকায় লিখার জন্য তিনি ফাউন্টেনপেন ব্যবহার করতেন কিন্তু সেগুলো পত্রিকা গুলোতে দাগ ফেলে দিত। কখনো কখনো সেগুলোর তীক্ষ্ণ ফলা পত্রিকার কাগজ গুলোকে ছিড়ে ফেলতো। লোকে ছেঁড়া পত্রিকা কিনতো না। বারবার কলমে কালি ঢোকানোও ছিল আজব ঝামেলা। কিন্তু তিনি দেখলেন কি পত্রিকায় যেসব কালি ব্যবহার করা হয় সেগুলো খুব দ্রুত শুকিয়ে যায়। তাই সেগুলো দিয়ে সাধারন কাগজেও লেখা যাবে। তিনি এই কালিটাকে ব্যবহার করে নতুন বলপেন বানান। তিনি এই কাজটা ঠিকঠাক করার জন্য তার ভাই জর্জ এর সাহায্য বেছে নিয়েছিলেন। তারা দুজন মিলে নতুন এক ধরনের বলপেন বানালেন যেটাতে নাকি সীসের মত নল ছিলো আবার। খোপ-টোপ কিছু ছিলো না। আর সেই সীসের মাথায় একটা বল লাগিয়েছিলেন ওনারা। দারুন বুদ্ধি নাহ! সীস দিয়ে কালি গিয়ে পড়বে ছোট বলে, আর সেটা ঘুরার সাথে সাথে বলটি সীসের কালিকে সামনে নিয়ে আসবে। জিনিয়াস দুই ভাই।

কাহিনী কিন্তু এখনো শেষ হয়নি! হঠাৎ এক গ্রীষ্মে কি হলো! ওদের দুই ভাইয়ের সাথে এক সাগরপাড়ে অগাস্টিন জুস্টো নামের এক প্রভাবশালী লোকের সাথে দেখা হয়ে গেলো। লোকটা আবার তখন ছিলো আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট। কি সাংঘাতিক কথা! তারা নিজেদের কাজের কথা সেই প্রেসিডেন্টকেও বলতে ছাড়লেন না। তখন অনেক আগ্রহ নিয়ে প্রেসিডেন্ট সব শুনলো ওদের বলপেন বানানো নিয়ে বিশাল কাহিনী, তারপর সেই প্রেসিডেন্ট যখন নিজের দেশ আর্জেন্টিনাতে ফিরে গেলেন তখন নিজেই একটা কলম তৈরির কারখানা বানালেন, আর সেটাতে তিনি সেই বিরো ভাইদের বানানো কলমের পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। তিনি প্রচার করা শুরু করলেন যে তার কোম্পানির কলম দিয়ে নাকি পানির নিচেও লেখা যায়! আহা! কি অপূর্ব!

কিন্তু বেচারা প্রেসিডেন্ট! তার ব্যবসায় লাল বাতি জ্বলা আরম্ভ হলো। কারন তার সেই কোম্পানির কলমে মারাত্মক একটা ত্রুটি ছিলো। সেটা হচ্ছে কলমের কালির অভিকর্ষ বল। মানে কলমটা দিয়ে লেখার জন্য একদম খাড়া করে রাখতে হতো কলমটাকে, তা না হলে কালি আসতো না কলমের মাথার বলে। এটা ছিলো ছোটখাটো ধরনের বিশাল সমস্যা। তারপর সেই সমস্যার একটা সমাধান বের করলো আর্জেন্টাইন কলম পন্ডিতেরা। সেটা কি? সেটা হচ্ছে সান্দ্রতা। (একটু পর বলতেছি জিনিসটা কি) সেই কলমটা অনেক ভালো বিক্রি হয় তখন আর্জেন্টিনার বিভিন্ন অঞ্চলে। তবে বেশিদিন সেই প্রেসিডেন্টের কলমের ব্যবসা টিকেনি। আমেরিকার এবারহার্ড কোম্পানি সেটা পরবর্তীতে সেটা কিনে নেয়।

তবে বলপেনের জগতে সবচেয়ে সফলতা লাভ করে মার্সেল বিক। বলপেনের নিন্ম মান আর উচ্চ দাম এটা তাকে অনেক আগ্রহী করেছিলো। তাই তিনি আমেরিকার বাজারের সমস্থ কলম নিয়ে জোরেশোরে গবেষণা শুরু করেন আর ১৯৫২ সালে তিনি অসাধারণ একটা কমদামী কলম নিয়ে আসেন বাজারে যেটার নাম ছিলো- Ballpen BIC.

এখন হচ্ছে আসলের আসল কথা। বলপেন আসলে কাজ করতো কিভাবে। বলপেনের মাথায় তো একটা ছোট বল থাকে, এইমাত্র জানলাম। আর সেটা কিন্তু সাধারন কোনো কিছু দিয়ে বানানো না, একদম নিখাদ স্টেইনলেস স্টীল (মরিচাবিহীন লোহা) দিয়ে বানানো। যেটাতে কোনোদিন মরিচা ধরার সুযোগ নেই। আর এই বিশাল বলটার ব্যাস মাত্র ০.৫ মিলিমিটার থেকে ১.২ মিলিমিটার। এটি একটা সকেটের মধ্যে লাগানো থাকে। সকেটের ঠিক পেছনে একটা ট্যাংক থাকে, যেটাকে ইঙ্ক ট্যাংক বলে। এই ট্যাংকে কিন্তু পানি থাকে না, গাড়ির তেল থাকে না, থাকে শুধু কালি, কালি আর কালি। যখন খাতার উপর কোনো কিছু লিখা হয় তখন খাতার সাথে ঘর্ষণ লেগে প্রচন্ড বেগে ছোট বলটা ঘুরতে থাকে। ফলে বলের পেছনের অংশ একবার সামনে আরেকবার পেছনে চলে যায়। যখন বলটা পেছনে থাকে তখন ইঙ্ক ট্যাংকের কালির কাছে থাকে ওটা। আর যখন সামনে খাতার কাছে আসে বলটা তখন ইঙ্ক ট্যাংক থেকে কালি চুরি করে খাতার উপর বসিয়ে দেয়। আবার যখন সামনের অংশটা পেছনে যায়, তখন খালি হাতে ফিরে যায়, তার কাছে কালি থাকে না। ইঙ্ক ট্যাংকে তখন অভিকর্ষ বলের ফলে কালি এসে যায় এবং বলের খালি অংশে আবার কালি লেগে যায়। এভাবে একটা মাত্র বর্ণ যদি তুমি বড় করে খাতায় লিখো তাহলে কয়েকশো বার ঘুরবে স্টেইনলেস স্টিলের বলটা।


আজকাল সব কলমে সান্দ্রতাকে ব্যবহার করা হয়। এটা অভিকর্ষ থেকেও অনেক নির্ভরযোগ্য। সান্দ্রতা হচ্ছে তরলের এমন একটা গুন যেটা কোনো সরু নল দিয়ে অভিকর্ষকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তরল তার আসঞ্জন বল (মানে একটি বস্তুর অণুদের ভিন্ন বস্তুর অণুদের প্রতি আকর্ষণ) আর পৃষ্ঠটানের প্রভাবে তরল উপরের দিকে উঠে যাওয়া। কলমের কালির মধ্যে সান্দ্রতাকে ব্যবহার করলে সহজেই কলমের কালিটা আটকে যাওয়ার ঝামেলা করে না। ফলে যত উল্টো করে রাখি না কেন কলম, সেটার সীসের খোলামুখ দিয়ে কালি পড়ে যাবে না। সান্দ্রতা ঠিক রাখার জন্য কলমের কালি একটু আঠালো ধরনের হয়। হাতে লাগিয়ে দেখতে পারো, কেমন যেনো চটচটে লাগবে কালি।


তবে জেল কলমের কালি কিন্তু দেখতেও সুন্দর, লেখতেও মজা। কারন এসব কলমের কালির সান্দ্রতা অনেক কম। মানে কম আঠালো হয়। তাই কাগজের উপর একটু খানি ধরে রাখলেই সেই কাগজে এত্তগুলো কালি পড়ে ভিজিয়ে দেয়। তাই এই সান্দ্রতাকে বাড়ানোর জন্য কলমের সীস গুলোকে মোটা করে বানানো হয়। পিজিক্সের ধর্ম আরকি, কোনো পদার্থের সান্দ্রতা তার ক্ষেত্রফলের সমানুপাতিক। যত ক্ষেত্রফল বাড়বে, সান্দ্রতা ততই বাড়বে। জেল পেনের সীস মোটা মোটা হয় এ জন্যই।